মনে করুন, কোনো এক সকালে ঘুম থেকে উঠে টের পেলেন আপনার মাথা ধরে আছে। কড়া এক কাপ কফি খেলেন, তারপর একটা প্যারাসিটামল খুঁজলেন বাসায়। যা হয়, দরকারের সময় অন্য সব ওষুধ থাকে, কেবল প্রয়োজনীয়টাই থাকে না। চরম মেজাজ খারাপ করে গেলেন অফিসে। অফিসে ঠিকমতো কাজগুলো হলো না, বিরক্তি আরও বাড়ল।
দুপুর নাগাদ মাথাব্যথা প্রচণ্ড হয়ে উঠলে বসকে বলে বাড়ি চলে এলেন আপনি। ভাবলেন একটা ঘুম দিলে ভালো লাগবে। পুরো বিকেল ঘুমিয়ে উঠেও মাথাব্যথাটা গেল না। মোড়ের দোকান থেকে প্যারাসিটামল আনিয়ে খেলেন। তা–ও যায় না ব্যথা। মাথার দুদিক একেবারে দপ দপ করছে। বিরস মনে শুয়ে শুয়ে গুগল করতে শুরু করলেন আপনি। সার্চ দিলেন ‘হেডেক’। অমনি ডক্টর গুগুল মাথাব্যথার কারণ, উপসর্গ, চিকিত্সা ও করণীয় নিয়ে হাজারটা তথ্য–উপাত্তের দুয়ার খুলে দিল আপনার সামনে। স্ক্রল করতে করতেই আপনি জানতে পারলেন যে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তীব্র মাথাব্যথা ব্রেন টিউমারের একটি লক্ষণ। যে মাথাব্যথা ব্যথার বড়িতেও সারে না, সেটাও ব্রেন টিউমার হতে পারে। চোখে ঝাপসা দেখা (তাই তো মাঝেমধ্যে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আজকাল) কিংবা বমি করা (আরে, পরশু না ক্যানটিনের খাবার খেয়ে বমি হলো!)—এগুলোও ব্রেন টিউমারের লক্ষণ। সর্বনাশ! আপনার শররীরটা কেমন যেন করতে লাগল। মনে হচ্ছে সবকিছু অবশ হয়ে আসছে। স্পষ্ট চিন্তা করতে পারছেন না। ছেলেটার বয়স মাত্র সাত বছর। স্কুলে পড়ে। এখনই বাবা মারা গেলে ওর কী হবে?
আচ্ছা, আমি মরে গেলে নিশ্চয়ই স্ত্রী আবার বিয়ে করবে!
করবে না–ই বা কেন!
ওরই–বা বয়স কত? সারা জীবন একা একা কাটাবে নাকি?
কিন্তু ফ্ল্যাটের কিস্তিগুলো যে দেওয়া হলো না। কে সামলাবে এসব?
আচ্ছা, ব্রেন টিউমারের চিকিত্সা কি খুব ব্যয়বহুল? হাতের কাছে তো গুগল মামা আছেনই, দেখে নেওয়া যাক। আপনি এবার পৃথিবীর বিভিন্ন হাসপাতালে ব্রেন টিউমারের চিকিত্সা সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করলেন। কী সর্বনাশ! অপারেশন, তারপর রেডিওথেরাপি। নিউরোআইসিইউ-এর খরচ! ফলোআপ। অসম্ভব! এত টাকা কোথায়? নাহ, চিকিত্সা না করেই মরে যেতে হবে দেখছি। বস কী কী যেন কাজ ধরিয়ে দিয়েছিল! ধুর, কী আর হবে কাজ করে! আয়ু ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। মাথাব্যথাটা আরও বেড়েছে।
সন্ধ্যায় আপনার স্ত্রী বাড়ি ফিরে দেখলেন আপনি বিছানায় শুয়ে গোঁ গোঁ করছেন। চোখ দুটো লাল। মুখে কথা সরছে না। আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো দ্রুত। নিউরোলজিস্ট আপনাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। মাথার সিটি স্ক্যান, এমআরআই করা হলো। আরও নানা ধরনের পরীক্ষা। চোখ, নাক, কান। দাঁত। না, সব কিছুই স্বাভাবিক। ডাক্তাররা অবশেষে মত দিলেন, আপনার মাথাব্যথাটা টেনশন হেডেক। আরও অনেকেরই হয়। অফিসে কাজের চাপ বেশি ছিল, এর বাইরে আরও নানা বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। সব মিলে উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা। খুবই সামান্য বিষয়। ট্রিটমেন্টও সাধারণ। ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। কিছু পরামর্শ দিলেন। টেনশন করতে মানা করলেন। এক সপ্তাহের মধ্যে ভালো বোধ করতে থাকলেন আপনি। মাঝখান দিয়ে অকারণে হাসপাতালে ভর্তি আর ইনভেস্টিগেশন বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল, ছুটিটাও নষ্ট হলো। ডিসেম্বরে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল, সেটা বরবাদ হলো আগাম ছুটি নষ্ট হওয়ার কারণে। কী একটা অবস্থা!
হ্যাঁ, আপনার যা হয়েছিল, তার একটা বৈজ্ঞানিক নাম আছে—সাইবারকনড্রিয়াসিস। ইংরেজি অভিধানে নতুন করে শব্দটা সংযোজন করতে বাধ্য হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সাইবারকনড্রিয়াসিস শব্দটা প্রথম ব্যবহৃত হয় ২০০১ সালে, ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এ। ওয়ালটার কিয়ার্ন নামের এক ভদ্রলোক এক নিবন্ধে লেখেন, ইন্টারনেটে স্বাস্থ্যবিষয়ক খোঁজাখুজি এক নতুন ধরনের রোগের জন্ম দিচ্ছে দুনিয়ায়, অকারণ হেলথ অ্যাংজাইটি বা স্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। পরে রায়ান হোয়াইট ও এরিক হরভিজ নামে দুজন মাইক্রোসফট রিসার্চার ২০০৮ সালে এ বিষয় নিয়ে বিশদ গবেষণা করেন। তাঁরা যা আবিষ্কার করেন, তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। তাঁরা দেখান, প্রতি পাঁচজনে দুজন মানুষ ইন্টারনেটে স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য খুঁজতে গিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটির শিকার হন। তাঁদের এই গবেষণা ২০০৯ সালে আমেরিকান মেডিকেল ইনফরমেটিকস অ্যাসোসিয়েশনের সিম্পোজিয়ামে পঠিত হওয়ার পরই সাইবারকনড্রিয়াসিস শব্দটি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।
সাইবারকনড্রিয়াসিসকে এখন মানসিক রোগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে আরেকটা মেডিকেল টার্ম ছিল, যার নাম হাইপোকনড্রিয়াসিস। হাইপোকনড্রিয়াসিস মানে হলো নিজেকে অকারণে অসুস্থ ভাবা, মানে যে রোগ হয়নি, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া। যেমন কারও কয়েক দিন ধরে কাশি হয়েছে, আর অমনি তিনি ভাবতে শুরু করলেন যে নিশ্চয়ই যক্ষ্মা হয়েছে। হাইপোকনড্রিয়াসিস সমস্যাটিকে বহু আগে থেকেই চিকিৎসকেরা মোকাবিলা করে আসছেন। একুশ শতকে এসে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে তাঁদের সামনে, তা হলো সাইবারকনড্রিয়াসিস। হাতের কাছেই ইন্টারনেট, গুগল থাকার কারণে এখনকার মানুষ খুব সহজেই রোগ ও তার লক্ষণ, উপসর্গ, জটিলতা, চিকিত্সার বিষয়ে জানতে পারছেন। নিজের সাধারণ উপসর্গে ডাক্তারের কাছে যাওয়াকে ঝামেলা ভেবে বেছে নিচ্ছেন ডক্টর গুগলকে। আর এই ডক্টর গুগল তার সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তাকে বাড়তি উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অহেতুক খরচ।
২০১৮ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখান যে যুক্তরাজ্যে সাইবারকনড্রিয়াসিস প্রায় মহামারির আকার নিয়েছে। কারণ, যুক্তরাজ্যের এনএইচএসের (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) প্রতি পাঁচজন রোগীর মধ্যে অন্তত একজনের আসলে কোনো রোগ নেই, তারা ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজের রোগ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। আর এই ‘নীরোগ’ রোগীদের অকারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, স্ক্যান ইত্যাদির পেছনে সরকারের বছরে ৪২০ মিলিয়ন পাউন্ড অযথা ব্যয় হয়েছে!
তাই বলে কি আপনি স্বাস্থ্যবিষয়ক গুগল সার্চ বন্ধ করে দেবেন? না, তা নয়। ইন্টারনেট আমাদের নানা বিষয়ে সঠিক তথ্য পেতে সাহায্য করতে পারে। কোনো রোগ বা তার চিকিত্সা সম্পর্কে সঠিক ও বিশদ তথ্য পেতে আপনি নির্ভরযোগ্য সাইটগুলোতে তো ঢুঁ মারতেই পারেন। কিন্তু তার জন্যও আছে কিছু নির্দেশিকা। প্রথম কথা হলো ইন্টারনেটে আপনি যেসব তথ্য পাবেন, তার সব কটি আপনার জন্য প্রযোজ্য না–ও হতে পারে। যেমন মাথাব্যথার কারণ হিসেবে সেখানে মাইগ্রেন বা টেনশন থেকে শুরু করে চোখে সমস্যা বা ব্রেন টিউমার পর্যন্ত অনেক কিছুই লেখা আছে। ভালো করে সব কটি তথ্য যাচাই করুন, চট করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন না। সন্দেহ হলে তো চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ আছেই। কিন্তু অযথা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন না। দ্বিতীয় কথা হলো ইন্টরনেটের সব তথ্য বা সব সাইটই নির্ভরযোগ্য নয়। ভুয়া সোর্স থেকে তথ্য নেবেন না। অমুক গাছের শিকড় সেদ্ধ করে খেলে ডায়াবেটিস কমে, এমন কথা যেমন আমাদের মতিঝিলের দেয়ালের পোস্টারে লেখা আছে, তেমনি কিছু কিছু সাইটেও এসব তথ্য পাবেন। যেকোনো তথ্য বিশ্বাস করবেন না।
বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য মেডিকেল ওয়েবসাইটগুলোর ওপর ভরসা করুন। এসব ওয়েবসাইটে যেমন তথ্যগুলো নির্ভরযোগ্য, তেমনি তা সহজে আপনাকে আতঙ্কিত করে তুলবে না। এতে যেকোনো সমস্যা বা রোগ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান দেওয়া হয়, বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দেওয়া হয়, তার সঙ্গে এমন কথাও লেখা থাকে যে কখন আসলে আপনার হাসপাতাল বা চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। আরেকটি কথা, সেলফ ডায়াগনোসিস বা নিজের রোগ নির্ণয় নিজে করতে যাবেন না। এটা একটা মারাত্মক ভুল। আর এই ভুলের কারণে উন্নত বিশ্বেও মানুষকে চরম খেসারত দিতে হয় প্রায়ই। তাই সচেতনভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করুন, ডক্টর গুগলের সাহায্য নিতেও আপত্তি নেই, কিন্তু তা যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া চাই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
No comments:
Post a Comment