এক গ্রামে ১৫ শকুনের বাস - NEWS ROOM

Breaking

Post Top Ad

Friday, March 3, 2023

এক গ্রামে ১৫ শকুনের বাস

কয়েক বিঘা জমির ওপর দেবদারু ও নারকেলগাছের বাগান তিনটি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের মগডালে বাসা করে কয়েক যুগ ধরে আছে বিশালাকায় পাখিগুলো। ওদের ওড়াউড়ি, দাপাদাপি, কোলাহলে মুখর থাকে বাগান ও আশপাশের এলাকা। পাখিগুলোর বিষ্ঠায় দুটি গাছের মরার অবস্থা। বাগানমালিকদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের চাওয়া, পাখিগুলো তবু থাকুক। কেউ যেন ওগুলোকে ক্ষতি না করে, সেদিকে সবার সতর্ক নজর।

মরা-পচা খেয়ে বেঁচে থাকা পরিবেশ-প্রকৃতির পরম বন্ধু এই পাখি সারা দেশে আছেই মোটে ২৬০টি। এর মধ্যে ১৫টি আছে পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা গ্রামের মোল্লাপাড়ার এই বাগানে। মহাবিপন্ন এই পাখিগুলোকে বাঁচাতে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, কেউ পাখিগুলোকে বিরক্ত করবে না। ওদের নিরাপদ খাবার সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এত সব আয়োজন মহাবিপন্ন 'বাংলা শকুনে'র জন্য।

 

প্রাণীর মরদেহের রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শকুন। উপকারী এই পাখি মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। অথচ পরিবেশের এমন নিবেদিত বন্ধু এখন মহাবিপন্ন পাখিতে পরিণত হয়েছে।

বন বিভাগের কর্মকর্তা ও পাখিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৪ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মহাবিপন্ন পাখি শকুন ছিল ২৬০টি। এখন পর্যন্ত এই সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত আছে। অর্থাৎ গত ৯ বছরে দেশে বাংলা শকুনের সংখ্যা খুব একটা কমেনি।

গত ৮–৯ বছরে দেশে বাংলা শকুনের সংখ্যা প্রায় একই রকম থাকাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বন্য প্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপু। তিনি এক যুগের বেশি সময় ধরে শকুন নিয়ে গবেষণা করছেন। সীমান্ত দীপু প্রথম আলোকে বলেন, রেমা-কালেঙ্গা ও সুন্দরবনের পর পাবনার বেড়ার ওই বাগান দেশে বাংলা শকুনের তৃতীয় কলোনি। সেখানে ১৫-২০টি বাংলা শকুন আছে। বনাঞ্চলের বাইরে লোকালয়ে দেশে একসঙ্গে এত বেশি শকুন কোথাও দেখা যায় না।

বেড়ায় প্রচুর গরুর খামার আছে। মরা গরু সহজেই পাওয়া যায়। তাই এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে শকুনের এই কলোনি গড়ে উঠেছে উল্লেখ করে শঙ্কার কথাও জানালেন সীমান্ত দীপু। কৌতূহলী অনেকে ঘুরতে, ছবি তুলতে যাচ্ছেন বাগানটিতে। এতে পাখিরা বিরক্ত হয়। পাখিদের নিরিবিলিতে থাকতে দেওয়ার আহ্বান জানান এই বন্য প্রাণী গবেষক।

 

কয়েক যুগ ধরে আছে ওরা

উত্তরাঞ্চলে শকুনের বাস নেই বলেই মনে করা হতো। তবে পাবনার বেড়ায় একসঙ্গে অন্তত ১৫টি শকুন দীর্ঘদিন ধরে আবাস গড়ে আছে। স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে ওই পাড়ার একটি বাগানের একটি দেবদারু ও একটি নারকেলগাছে শকুনেরা বাসা বানিয়েছে। তবে ওই বাগানে দিন দিন শকুনের সংখ্যা কমছে। আগে গাছ দুটিতে ৩৫ থেকে ৪০টি শকুন ছিল।

এ শকুনগুলোকে রক্ষা করলে এলাকাবাসীই উপকৃত হবেন বলে মনে করেন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, 'শকুন পরিবেশ ও প্রকৃতির বন্ধু। এসব শকুন রক্ষার জন্য এলাকাবাসীকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। আমার জানামতে, উত্তরাঞ্চলে বেড়া উপজেলার মতো এত শকুনের বাস আর কোথাও নেই। তাই শকুনগুলো রক্ষায় আমরা এলাকাবাসীর সহায়তায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

সম্প্রতি বন বিভাগের কর্মকর্তারা চাকলা গ্রামের মোল্লাপাড়ার বাগানটি পরিদর্শন করেছেন। শকুনগুলো 'বাংলা' প্রজাতির জানিয়ে বেড়া উপজেলার বন কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, 'বাংলা শকুন এখন বিলুপ্তির পথে। ওই গ্রামের কয়েকজন আমাকে সেখানে শকুনের বাস রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন।' তিনি ওই এলাকায় গিয়ে এর সত্যতা পেয়েছেন। পাখিগুলোকে বিরক্ত না করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্বুদ্ধ করছেন বলে জানান এই বন কর্মকর্তা।

সরেজমিনে একদিন

সম্প্রতি মোল্লাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার আবদুল মালেক, আমিনুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেনের বাগানে শকুনের দল চার থেকে পাঁচটি বাসা তৈরি করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে ওই বাগানে শকুনের বাস। শকুনগুলো সকালে খাবার খুঁজতে বের হয়। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে আসে। মাঝেমধ্যেই উঁচু ডাল থেকে শকুনের বাচ্চা পড়ে গিয়ে আহত হয়ে মারা যায়। গত ৮-১০ বছরে ওই বাগানে বেশ কয়েকটি বড় শকুনকেও অসুস্থ হয়ে মারা যেতে দেখেছেন তাঁরা।
শকুন বাস করে এমন একটি বাগানের পাশেই বাস করেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, 'পাঁচ বছর আগেও এই তিন বাগানে ৩৫ থেকে ৪০টি শকুন দেখেছি। ওই সময় বাগানে হাঁটতে গেলেই শকুনের গায়ের ও বিষ্ঠার ঝাঁজালো গন্ধ নাকে আসত। এখন শকুন কমে গিয়ে ১৫টির মতো হয়েছে। গত কয়েক বছরে অনেক শকুনকে মরে যেতে দেখেছি।'

জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, বাসাগুলোতে শকুনগুলো বাচ্চা দিয়েছে; তবে বাচ্চার সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বন বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, শকুন নিয়ে সম্প্রতি আবারও জরিপ শুরু হয়েছে। জরিপ শেষ হলে বর্তমানে শকুনের প্রকৃত সংখ্যা কত, তা জানা যাবে।

বিলুপ্তির কারণ

বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শকুন বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গবাদিপশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দুই ওষুধের প্রভাব মৃত গবাদিপশুর দেহেও থাকে। ফলে মৃত গবাদিপশুর মাংস খেয়ে মারা যাচ্ছে শকুন। পরিবেশবাদী ও পাখিবিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও প্রচারণার পর ২০১০ সালে বাংলাদেশে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এখনো দেশে ওষুধটি বিক্রি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে মোট ১৮ প্রজাতির এবং বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলা শকুনকেই অন্যতম মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও শকুন বিলুপ্তির পথে।

 

শকুন রক্ষায় উদ্যোগ

বন অধিদপ্তরের গাজীপুরে অবস্থিত শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের পাখিবিশেষজ্ঞ শিবলী সাদিক বেড়ায় শকুনের ওই আবাস্থলে যান। এ সময় শকুনগুলো রক্ষায় তিনি এলাকাবাসীর সঙ্গে বৈঠক করে একটি কমিটি গঠন করেন।

শিবলী সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, 'আমার হিসাবে মোল্লাপাড়ায় অন্তত ১৫টি শকুন রয়েছে। এগুলো রক্ষার জন্য এলাকাবাসীসহ গাছের মালিকেরা আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছেন। শিগগির আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওই এলাকায় আসবেন এবং শকুনের জন্য সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করবেন বলে আশা করছি। এ ছাড়া সেখানে শকুনের নিরাপদ খাবার সরবরাহেরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।'

 

 

 

 

 

No comments:

Post a Comment

Pages