সাধারণ নির্বাচন হবে আরও দুই বছর পর। ইদানীং নির্বাচন আর ‘সাধারণ’ থাকছে না। এটা ক্রমেই হয়ে উঠেছে তামাশা। এই তামাশার তিন অংশীদার—সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে নির্বাচনের যে ধরন দাঁড়িয়ে গেছে, তা নিঃসন্দেহে রাজনীতিবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্ব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। রাজনীতিশাস্ত্র যেটা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, তার তাত্ত্বিক আর প্রায়োগিক দিকের মধ্যকার ফারাক এমন বেশি যে ছাত্রদের এই সব তত্ত্ব কীভাবে গেলানো হয়, তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ধরে না।
রাজনীতির মাঠে এখন সবচেয়ে সক্রিয় চারজন। তাঁদের দুজন আওয়ামী লীগের আর দুজন বিএনপির। তাঁরা প্রতিদিন নিয়ম করে ওয়াজ-নসিহত করেন। মিডিয়া তা প্রচার করে। একেকজনের প্রকাশভঙ্গি একেক রকম। একজন স্ক্রিপ্ট দেখে কথা বলেন। শিগগিরই হয়তো কয়েক খণ্ডে তাঁর রচনাবলি তৈরি হবে। টিভির পর্দায় তাঁদের চেহারা দেখলেই আমরা বুঝে ফেলি তাঁরা কী বলবেন। এর ফাঁকে ফাঁকে অন্য নেতারাও উঁকিঝুঁকি দেন। তবে মিডিয়ার কাছে তাঁদের চাহিদা কম। কথাবার্তা একঘেয়ে হয়ে যাওয়ায় মানুষ আর তাঁদের কথায় উল্লসিত কিংবা উত্তেজিত হয় না। ম্যাড়মেড়ে ফুটবল হলে গ্যালারি যেমন শূন্য থাকে, তাঁদের অবস্থাও অনেকটা এ রকম। মিডিয়ার লোকেরা তাঁদের কাছে না গেলে তাঁরা এতিম হয়ে যেতেন।
নির্বাচন একটা হবে। নিয়মরক্ষার জন্যই এটা হতে হবে। ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এ দেশে নির্বাচনে প্রার্থীর আকাল পড়েনি কোনো দিন। দিন দিন দেশসেবকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সবাই জনসেবা করতে মুখিয়ে আছেন। নির্বাচন না করেও যে সমাজসেবা ভালোভাবেই করা যায়, তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। কিন্তু নির্বাচনের আকর্ষণ অন্য রকম। এ এক সোনার হরিণ। ধরতে পারলে দশতলা দুর্গসম দালানটির বাসিন্দা হওয়া যায় কমপক্ষে পাঁচ বছর।
সামনে যে নির্বাচন আসছে, তা নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কতটুকু সিরিয়াস, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার একটা ড্রেস রিহার্সাল হয়ে যাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। ঐতিহ্য বজায় রেখেই এখানে লাঠালাঠি, মারামারি ও খুনোখুনি চলছে। এখন তো ইউনিয়ন পরিষদের অনেক ক্ষমতা, অনেক বাজেট। এতে ভাগ বসাতে পারলে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি সবই জুটবে। এমনকি বউ-শালীরা দুস্থ ও বিধবা ভাতা পাওয়ারও যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
সামনে যে নির্বাচন আসছে, তা নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কতটুকু সিরিয়াস, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার একটা ড্রেস রিহার্সাল হয়ে যাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। ঐতিহ্য বজায় রেখেই এখানে লাঠালাঠি, মারামারি ও খুনোখুনি চলছে। এখন তো ইউনিয়ন পরিষদের অনেক ক্ষমতা, অনেক বাজেট। এতে ভাগ বসাতে পারলে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি সবই জুটবে। এমনকি বউ-শালীরা দুস্থ ও বিধবা ভাতা পাওয়ারও যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
১৯৯১ সাল থেকে দেখা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাপ্রত্যাশীর দুই শরিকে লড়াই হয়। এদের কথাবার্তা, আচরণ, কাজকর্ম ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলা যেতে পারে। মূল পার্থক্য একটাই—এক শরিক সরকার চালায়, অন্য শরিক আগে বিরোধী দলে বসত, এখন চেয়ে চেয়ে দেখে। দুই শরিককে এক করে দেখলে কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ন হন—আমাদের এক পাল্লায় মাপলেন? মুশকিল হলো, পাল্লা তো নিরপেক্ষ। কেউ কেউ এমনও বলেন, আমরা তো বড়। ছেলেবেলার সেই ধাঁধার কথা মনে পড়ে—বল তো, এক সের লোহা আর এক সের তুলার মধ্যে কোনটা বেশি ভারী?
যাঁরা এখন সংসদ আলোকিত করে আছেন, তাঁরা সবাই খোয়াব দেখছেন, আবারও ফিরে আসবেন। যাঁরা চেয়ে চেয়ে দেখছেন বা নির্বাচন করেও জুত করতে পারেননি, তাঁরাও স্বপ্ন দেখেন সংসদে ঢোকার। স্বপ্ন তো মানুষ দেখতেই পারে। দুই শরিকের নির্বাচনে প্রার্থীদের মনের কথা লিখতে গেলে আরেকটা ‘খোয়াবনামা’ হয়ে যাবে। আগামী নির্বাচনটা কেমন হবে, এ হলো এখন প্রশ্ন। অদৃষ্টবাদীরা ধরেই নিয়েছেন, এটি ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতোই হবে। আর যাঁরা আশাবাদী, কলিজার জোর সাংঘাতিক, তাঁদের মনের কোণে একটা ‘অবাধ’ নির্বাচনের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। মোটকথা, সবাই ধন্দে পড়ে গেছেন। দুই শরিকের যাঁরা কর্তা, তাঁরাও ঝেড়ে কাশছেন না। নির্বাচনের খরচ অনেক। তহবিল নিয়ে বসে আছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। সবাই আশা করছেন, শিকে ছিঁড়বে তাঁর গলায়। কিন্তু সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। নেতার মন তো বোঝা ভার। তিনি কী তালিকা বানাচ্ছেন, তা কেউ জানেন না। তাই সবাই আছেন অস্বস্তির মধ্যে।
নির্বাচনের ধরনধারণ কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করছে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা। সংবিধানের ৭০ ধারা এখন মাঠপর্যায়ে হালে পানি পায় না। আর সংবিধান কে পড়েন? সবাই এটা পড়লে আর বুঝলে তো এত দিনে সোনার বাংলা হয়েই যেত। আর কিছুদিন বাদে দুটো কাজ শুরু হয়ে যাবে বা হয়তো ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। একটি হলো নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি। দুনিয়ার এমন কোনো সুবচন নেই, যা ইশতেহারে থাকবে না। দেশ দুধ আর মধুর নহরে ভাসানোর সব ওয়াদাই থাকবে। এখানেও একটা সমস্যা। মিডিয়া ছাড়া আর কারও কাছে ইশতেহারের গুরুত্ব আছে কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়। আমজনতা ইশতেহার পড়ে না। কোনো দল তার সামনের কাতারের নেতা-কর্মীদের বাড়ি তল্লাশি করে দেখতে পারে, গত পাঁচটি নির্বাচনের, এমনকি গতবারের নির্বাচনী ইশতেহারটাও তাঁদের বুকশেলফে আছে কি না। অবশ্য বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর বাসায় বুকশেলফ আছে কি না, তা-ও একটি প্রশ্ন। শেলফ হয়তো আছে। কিন্তু তাতে বুক নেই। আছে নেতার সঙ্গে বাঁধানো ছবি, ক্রেস্ট আর বিদেশভ্রমণের কিছু স্মারক-স্যুভেনির। তাঁদের অনেকেই আবার স্বশিক্ষিত।
নির্বাচনের জন্য দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল। এ তো রীতিমতো একটা যুদ্ধ। জিতলে পুরো দেশটাই গনিমতের মাল। আর হারলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের আশঙ্কা। গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখেছি, ইশতেহার নয়, কৌশলেরই জিত হয়েছে। নির্বাচন এখন জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাধ্যম নয়। এ হলো কৌশলের খেলা। আপনি সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেন, ৯০ মিনিটের খেলায় ৮০ মিনিটই বল আপনার দখলে। কিন্তু গোল দিয়ে দিল প্রতিপক্ষ। রেকর্ড বইয়ে লেখা থাকবে, অমুক দল ১-০ গোলে জিতেছে। ট্রফিটা সে-ই পাবে।
প্রশ্ন হলো, দলে দক্ষ ও কুশলী স্ট্রাইকার আছে কি না। থাকলে জিতবে, না থাকলে হারবে—এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যাঁরা হেরে যাবেন, তাঁরা নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে কী কী বলবেন, তা এখনই লিখে দেওয়া যায়। আর জয়ী দলের নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার প্রতিটি শব্দই তো আমাদের মুখস্থ। ছোট দলগুলোর এ ধরনের সমস্যা নেই। তারা প্রায় সবাই দুই শরিকের কোনো একটার গৃহপালিত। এর বাইরে ছোটখাটো আরও দল আছে, যারা তৃতীয় স্রোতের কথা বলে। তাদের অনেকের কথা জনগণের কাছে পৌঁছে না বা পৌঁছালেও জনগণ তা বোঝে না। সাম্রাজ্যবাদ, গণতন্ত্র, সুশাসন—এসব ভারী ভারী শব্দ গতর খেটে খাওয়া মানুষের মাথায় ঢোকে না। তাঁরা কেউ শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমের বাইরে যেতে পারেননি।
আমার সঙ্গে কেউ কথা বলতে এলে আমি যখন এসব বলি, তখন তাঁরা আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান—আপনি হতাশাবাদী? কেউ কেউ বলেন, তাহলে কী করতে হবে? লেনিনের একটি বই আছে—কী করিতে হইবে। এটি এখন অচল। এখন কেউ আর কমিউনিজমের কথা বলেন না। তাঁরা সবাই চান ‘উদার গণতন্ত্র’, ‘গুড গভর্ন্যান্স’।
আমি আসলেই খুব আশাবাদী। আমি দেখেছি শুধু নয়, অংশও নিয়েছি। এ দেশে ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জেনেছি, বুঝেছি। তরুণেরাই নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁদের বয়স ছিল বিশ-তিরিশের কোঠায়। দুনিয়াজুড়ে সব পালাবদলের আর প্রগতির লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন তরুণেরা। অতিসম্প্রতি আমরা দেখেছি মালালা ইউসুফজাই কিংবা গ্রেটা থুনবার্গকে।
১৯৬৯ বা একাত্তরের তরুণেরা এখন প্রবীণ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাঁদের অনেকেই এখনো গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চেঁচাচ্ছেন। কিন্তু তরুণেরা কোথায়? কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক জরিপে দেখেছি, তরুণদের ৮২ শতাংশ এ দেশে থাকতে চান না। এর কারণ কী? তাঁরা কি এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ দেখেন না? এটা আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা বোঝেন ভালো। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের আগেভাগেই পশ্চিমের দেশগুলোতে ‘উচ্চশিক্ষার্থে’ পাচার করে দিয়েছেন। যাঁদের মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে, সেই সব শিল্পপতি, আমলা, শিল্পী, সাংবাদিক, লেখকও বাদ নন। সবাই এক পা দিয়ে রেখেছেন পশ্চিমে। তো দেশটা কাদের হাতে থাকবে?
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
No comments:
Post a Comment